দেশের ডাক।
২০২৪ সালের ৫আগস্ট, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে একটি প্রবল বিপ্লব ঘটেছিল, যখন শেখ হাসিনার আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়। প্রাথমিক ভাবে, যে গল্পটি সামনে এসেছিল তা ছিল একটি বৃহৎ ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ফল স্বরূপ সরকারের পতন — যাছিল একস্বতঃ স্ফূর্তউত্থান স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে। তবে, ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ার পর, একটি আরো জটিল এবং গোপন রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার চিত্র সামনে আসতে শুরু করে। সামরিক গোষ্ঠী, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি, বিশেষ করে ইসলামী শক্তি গুলি, এবং বিদেশি হস্তক্ষেপের ছায়া সবই এই বিপ্লবে গুরুত্ব পূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
বিভক্ত জোট এবং অস্থায়ী ঐক্য
সরকারের পতনের পরপরই, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটি বিরল ঐক্য তৈরি হয়েছিল বলে মনে হয়েছিল। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদীদল (বিএনপি), জামাত-ই-ইসলামী, এলডিপি, খেলাফত মজলিস এবং ইসলামী ঐক্যজোট সহ যে দলগুলি আওয়ামীলীগের আধিপত্যের বিরোধিতা করেছিল, তারা একত্রিত হয়ে একটি শক্তিশালী বিরোধী জোট গঠন করেছিল। যদিও তাদের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় মতাদর্শে পার্থক্য ছিল, কিন্তু তাদের লক্ষ্য একছিল — আওয়ামীলীগের স্বৈরাচারী শাসনকে উৎখাত করা।
তবে, যতই সময় গড়িয়েছে, ততই এই জোটের ভাঙন দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। এক সময় যে ঐক্যটি অটুট বলে মনে হচ্ছিল, তা এখন রুক্ষ প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পরিণত হয়েছে। এখন প্রতিটি গোষ্ঠী তাদের ভাগে অধিক ক্ষমতা দখল করতে মরিয়া, প্রায়শই নির্মম কৌশল অবলম্বন করে যাতে নিজেদের প্রতিপক্ষকে নির্মূল করা যায়। এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুধু আওয়ামীলীগের রক্ষীদের বিরুদ্ধে নয়, নিজেদের মধ্যেও চলছে।
বিশৃঙ্খলার উত্থান এবং আনুগত্যের পরিবর্তন
এই অনিশ্চিত পরিবেশে, একটি স্থিতিশীল সরকারের অভাবে দেশ এখন বিশৃঙ্খলায় ডুবে গেছে। রাজনৈতিক প্রতিশোধ নেওয়ার প্রবণতা এখন সাধারণ ঘটনা। একসময়ের সহযোদ্ধারা এখন শত্রুতে পরিণত হয়েছে, এবং হিংসাত্মক প্রতিশোধ নেওয়ার ঘটনা দেশ জুড়ে ঘটছে। বিএনপির কোন নেতা যিনি এলডিপি বা জামায়াতে ইসলামীতে আশ্রয় নিয়েছিলেন এখন তারা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। কারণ আগের সন্দেহ এবং শত্রুতা গুলি আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। অন্যদিকে, যারা ৫আগস্ট ২০২৪ পরবর্তী সুযোগ কাজে লাগিয়ে ক্ষমতা অর্জন করেছেন, তারা এখন নতুন আসা প্রতিদ্বন্দ্বীদের দ্বারা নিপীড়িত হচ্ছেন।
এই প্রতিশোধের চক্র শুধুমাত্র দলের নেতাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, মাঝারি স্তরের কর্মী এবং প্রান্তিক সমর্থকরাও এর শিকার হচ্ছেন। যারা দোষারোপের জন্য সন্দেহ ভাজন বা রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগ নিয়েছেন, তাদের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে, ব্যক্তিগত শত্রুতা এখন রাজনৈতিক প্রতিশোধের পাত্রে পরিণত হয়েছে, যা পরিস্থিতি আরও জটিল করেছে।
ধর্মীয় গোষ্ঠী গুলির ভূমিকা
ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলি, বিশেষ করে যারা রাজনৈতিক ক্ষমতার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে, বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে একটি গুরুত্ব পূর্ণ শক্তি হিসেবে উঠছে। যদিও প্রথমে তারা আওয়ামীলীগের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ ছিল, বর্তমানে তাদের মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে ইসলামী ঘরানার হেফাজতে ইসলাম, জামাত-ই-ইসলামী এবং খেলাফত মজলিসের প্রভাব বেড়েছে, কিন্তু পাশাপাশি তাদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং বিদ্বেষও বৃদ্ধি পেয়েছে। ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলির মধ্যে এই আধিপত্যের লড়াই অনেক সময়স হিংস সংঘর্ষের রূপ নিয়েছে, যেখানে একে অপরকে বিশ্বাসঘাতক তার অভিযোগে দোষারোপ করা হচ্ছে।
অন্ধকারভবিষ্যৎ
ভবিষ্যতের দিকে তাকালে, এটা স্পষ্ট যে এই অস্থিরতা দীর্ঘ মেয়াদী হবে। অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতার লড়াই এবং একটি একত্রীকৃত জাতীয় দৃষ্টি ভঙ্গির অভাবে, মীমাংসার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছেনা। একটি রাজনৈতিক পরিবেশে যেখানে জোট অস্থায়ী এবং শত্রুতাগুলি স্থায়ী, সেখানে কোনো দল বা ব্যক্তি দীর্ঘদিন নিরাপদ থাকতে পারবে না।
বাংলাদেশ এখন একটি বিপজ্জনক মোড়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ক্ষমতার পরিবর্তনশীল গতি পথে এমন একটি পরিবেশ তৈরি হয়েছে যেখানে অনিশ্চয় তারাজ করছে। যত দিন না একটি বৈধ এবং বিস্তৃত ভাবে গ্রহণ যোগ্য রাজনৈতিক কাঠামো প্রতিষ্ঠিত হয়, ততদিন এই প্রতিশোধ এবং বিশ্বাসঘাতকতার চক্র চলতে থাকবে। জাতির জন্য চ্যালেঞ্জ শুধু গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলি পুনর্গঠন করা নয়, বরং রাজনৈতিক সহিষ্ণু তার সংস্কৃতি গড়ে তোলা, যা এখনো বহুলাংশে অনুপস্থিত।
বাংলাদেশের ভবিষ্যত আগামী মাসও বছরগুলিতে নির্ধারিত হবে, এটি দেখার বিষয় যে দেশটি এই চক্র থেকে বের হয়ে আসতে পারে কিনা, অথবা তার রাজনৈতিক ভবিষ্যত কি ফ্যাসিস্ট এবং ধর্মীয় মৌলবাদের দ্বন্দ্বে আটকে থাকবে।